অসহযোগ আন্দোলন(Non Co-operation Movement)

  • ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর নাগপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশনে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন ।
  • সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করে ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে ব্যর্থ করে দেওয়াই ছিল গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ।
  • দীর্ঘ ৩৫ বছর পর কংগ্রেস তার চিরাচরিত আবেদন-নিবেদন নীতি তথা 'রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি' পরিত্যাগ করে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দিকে অবতীর্ণ হয়েছিল ।

পটভূমি

  • স্বায়ত্তশাসন অর্জনে ব্যর্থতা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার স্বায়ত্তশাসন দান প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ভারতীয় অর্থ এবং সামরিক শক্তি যুদ্ধে ব্যবহার করে। কিন্তু যুদ্ধের অবসানে দেওয়া হল ‘ মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার ’ যা ভারতীয়দের কাছে ছিল ‘ তুচ্ছ , বিরক্তিকর ও নৈরাশ্যজনক ’ । এর ফলেই ক্ষুদ্ধ ভারতবাসী এক গণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিল ।
  • কুখ্যাত রাওলাট আইন:- ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত রাওলাট আইন পাস ( ১৯১৯ খ্রি. ১৮ মার্চ ) করিয়ে ভারতবাসীর ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল । রাওলাট আইনের প্রতিবাদেই গান্ধিজি সত্যাগ্রহের ডাক দেন ।
  • জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড:- রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলার জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক এক উদ্যানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে উপস্থিত নিরীহ মানুষদের ওপর জেনারেল ডায়ার ও তার নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী গুলি চালায় । এতে সরকারি হিসেবে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হয় । ব্রিটিশের এই ঘৃণ্য কাজ ভারতীয়দের অসন্তোষের কারন হয়ে ওঠে।
  • খিলাফত সমস্যা:- গান্ধিজি চেয়েছিলেন খিলাফত সমস্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে । এতে একদিকে যেমন ব্রিটিশ বিরােধী জাতীয় আন্দোলন শক্তিশালী ও তীব্র হয়ে উঠবে , অপরদিকে তেমন ব্রিটিশ সরকারের হিন্দু – মুসলিম বিভেদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে । তাই তিনি কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি ও ইসলামের আবেগকে মিশিয়ে এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ।
  • আর্থিক সমস্যা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বহুগুণ বেড়ে যায় । মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ ভারতবাসীকে জেরবার করে তােলে । এই আর্থিক সংকট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ভারতবাসী ব্রিটিশ বিরােধী গণ আন্দোলনের তাগিদ অনুভব করে ।
  • শ্রমিকদের দুর্দশা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাপক ভাবে শিল্প কারখানাগুলিতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় । এমনিতেই শ্রমিকদের কম মজুরি , বাসস্থানের অভাব , কাজের সময়সীমা , কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইত্যাদি ব্যাপারে ক্ষোভ ছিল । এর ওপর শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে তারা ধর্মঘট করে ।
  • কৃষকদের দুরবস্থা:- যুদ্ধজনিত কারণে ভারতীয় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়লে , তাকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ভূমি রাজস্বের হার বাড়ায় । ভূমি রাজস্বের এই হার বৃদ্ধির জন্য সব থেকে বেশি মাশুল দিতে হয় কৃষক সম্প্রদায়কে । কৃষিজাত পণ্যের দাম না বাড়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রয় করে লাভ পেত না । অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের অত্যন্ত কম দামে মহাজনদের কাছে কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে হত , কিন্তু বেশি দাম দিয়ে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য কিনতে হত ।
  • দেশীয় শিল্প উদ্যোগে বাধা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অর্থ সংকট তীব্র হওয়ায় আমজনতার পক্ষে শিল্পজাত পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে যায় । এ সময় নানা কারণে দেশীয় শিল্পক্ষেত্রগুলিতে মন্দা দেখা দেয় । যুদ্ধের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে ধ্বংস করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে । দেখা যায় তৎকালীন ভারত-সচিব মর্লে মাদ্রাজে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পোদ্যোগকে আটকানাের গােপন নির্দেশ দেন বা ভদ্রাবতী লৌহ প্রকল্প ও কৃষ্ণসার সাগর বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা রুপায়ণে নিয়ােজিত বিশ্বেশ্বরাইয়া ( মহীশূরের দেওয়ান ) -কে পদচ্যুত করা হয় ।

কর্মসূচিএই সকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গান্ধিজি তাঁর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন ।

  • কর্মসূচির নেতিবাচক দিকগুলি হল—
    • আইনসভা ও সরকারি অফিস আদালত বর্জন করা,
    • সরকারি উপাধি, পদক, খেতাব, সমস্ত সরকারি অনুষ্ঠান ইত্যাদি বর্জন করা,
    • সরকারি স্কুলকলেজ থেকে ছেলেমেয়েদের নাম প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া,
    • সমস্ত বিদেশি পণ্যদ্রব্য বর্জন করা,
    • সরকার কর্তৃক মনোনীত সদস্যপদ বর্জন করা,
    • সকল শ্রেণির সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মচারীর বিদেশ গমনে অস্বীকৃতি ইত্যাদি ।
  • আন্দোলনের ইতিবাচক দিকগুলি হল—
    • চরকায় সুতো কাটা এবং খাদি বস্ত্র উত্পাদন ও ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন করা,
    • জাতীয় স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা ,
    • নিরক্ষরতা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা,
    • দেশীয় শিল্পজাত পণ্য গ্রহণ করা,
    • দেশের গণ্যমান্য মানুষদের নিয়ে সালিশি বোর্ড গঠন করা ইত্যাদি ।

আন্দোলনের প্রসার ও প্রত্যাহার:

  • ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেস এই কর্মসূচি গ্রহণ করে গান্ধিজিকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার সর্বময় দায়িত্ব অর্পণ করেন ।
  • জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিলেন ।
  • অসংখ্য ছাত্র স্কুল, কলেজ বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল । দেশবাসীর উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে কাশী বিদ্যাপীঠ, বারাণসী বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় । ডক্টর জাকির হোসেন, আচার্য নরেন্দ্র দেব, লালা লাজপত রায় প্রমুখ শিক্ষাবিদগণ এই সব নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন ।
  • মতিলাল নেহরু, ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ আইনজীবীগণ আইন ব্যবসা ত্যাগ করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন । সুভাষচন্দ্র বসু সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে এবং জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদ হাইকোর্ট ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন । মহাত্মা গান্ধির ডাকে ডঃপ্রফুল্ল ঘোষ সরকারি উচ্চপদে ইস্তফা দিয়ে, প্রফুল্ল সেন, অজয়্ কুমার মুখার্জি উচ্চশিক্ষার মোহ বর্জন করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ।
  • এভাবে একে একে মেদিনীপুরের যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নদিয়ার হেমন্ত সরকার, বরিশালের যতীন সেন, ময়মনসিং -এর ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ আরও অনেকে তাঁদের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে এগিয়ে এলেন ।
  • শুধু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল নয়, দেশের শ্রমিক শ্রেণি কলকারখানা ছেড়ে এবং কৃষক শ্রেণি ও গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষও এই অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন । সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, মেদিনীপুরের কৃষক, মহারাষ্ট্রের শ্রমিক, উত্তরপ্রদেশের ক্ষেতমজুর, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলে এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন ।
  • আমেদাবাদে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুসারে গান্ধিজি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি সুরাট জেলার বরদৌলিতে গণ আইন অমান্য আন্দোলনের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেন । এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিপুল উত্সাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয় ।
  • কিন্তু ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেরুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় একদল হিংসাত্মক জনতা এক পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন লাগিয়ে ২২ জন পুলিশ কর্মচারীকে পুড়িয়ে মারে । গান্ধিজির কানে এই সংবাদ পৌঁছুলে তিনি তত্ক্ষণাৎ আন্দোলন বন্ধের আদেশ দেন ।
  • মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধিজির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হন । কেউ একে 'জাতীয় বিপর্যয়' কেউ 'পর্বত প্রমাণ ভুল' বলে মন্তব্য করেন । তথাপি কংগ্রেস কার্য নির্বাহক সমিতি গান্ধিজির এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন ।